Friday, January 20, 2017

নারী নির্যাতন মামলা : অধিকাংশই ভুয়া ও হয়রানিমূলক

পুরান ঢাকার নিমতলীর মুদি ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। ২০১১ সালে তার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা করেছেন সাবেক স্ত্রী। আপস-মীমাংসার কথা বলে এ পর্যন্ত আদায় করেছেন ছয় লাখ টাকা। মিথ্যা মামলায় সাত মাস সাজাভোগও করেন নজরুল ইসলাম। সর্বশেষ গত বছরের ১২ জুলাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় ধর্ষণের অভিযোগে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার সাবেক স্ত্রী। মামলাটির তদন্ত করেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার এসআই আসাদুজ্জামান তালুকদার। নজরুলকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। এতে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে করা সাতটি মামলার তালিকা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা- যার সবগুলোই ওই নারীর করা। এসব মামলা থেকে নজরুল ইতিমধ্যে অব্যাহতি ও খালাস পেয়েছেন।

সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করায় ওই নারীকে ৪ এপ্রিল কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার ১ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেসমিন আরা বেগম। আদেশের পর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ওই নারী আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে। আমার ব্যবসা-টাকা-সময় অপচয় করিয়েছে। আইন অনুসারে আমি তার উপযুক্ত শাস্তি চাই।’

শুধু নজরুল ইসলামই নন, এভাবে অনেক পুরুষই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অপব্যবহার করছে এক শ্রেণীর কুচক্রী মহল। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতেই এরা এ আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে এ আইনটি হয়ে উঠেছে নির্যাতন ও হয়রানির বড় হাতিয়ার। প্রতিশোধ, স্বামীকে বাগে রাখা, শ্বশুর-শাশুড়িকে শায়েস্তা করা, প্রেম করে স্বেচ্ছায় পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে উদ্ধার কিংবা কোনো তুচ্ছ কারণে প্রায়ই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা করা হয়। কারণ, এ মামলায় আসামি সহজে জামিন পান না। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে সমাধানের পথ খোঁজে অনেকেই। তবে মিথ্যা মামলায় বাদীর সাজা নিতান্তই কম। ফলে ভুয়া ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো করতে দ্বিধা করছে না অপরাধী চক্র। বহু নিরপরাধী ওই চক্রের খপ্পরে পড়ে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় কারাভোগ করছেন। ভুক্তভোগী হচ্ছেন তথাকথিত আসামিরা।

ঢাকার পাঁচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ আইনে দায়ের করা অধিকাংশ মামলাই চূড়ান্তভাবে শেষ হয় না। এর আগেই বাদী-বিবাদী আদালতের বাইরে সামাজিকভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে। তাই অনেকে এসব মামলার অধিকাংশকেই মিথ্যা বলে অভিহিত করেন। ঢাকার পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের মামলার নিষ্পত্তির হিসাব থেকে দেখা যায়, তিন মাসে ৯১৯টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬২৯টি মামলায় আসামিদের অব্যাহতি ও ২৮৬টি মামলায় আসামিরা খালাস এবং ৪টি মামলায় আসামিরা সাজা পেয়েছেন।

জানতে চাইলে মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল এ আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধের যথাযথ বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে ভুক্তভোগীদের রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা পুরোপুরি হতাশাজনক। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে অনেকেই এ আইনের অপব্যবহার করছে। প্রায়ই দেখা যায়, এ আইনের অধীনে করা অধিকাংশ মামলাই চূড়ান্তভাবে শেষ হয় না। যেমন বাদীর বাড়ি টাঙ্গাইল, কিন্তু সে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে ঢাকার যে কোনো ঠিকানা ব্যবহার করে ঢাকার আদালতে মামলা করেন।’

জানতে চাইলে ঢাকার পাঁচ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এপিপি শম আবদুল আওয়াল বকুল যুগান্তরকে বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালে প্রায় ৩ হাজার মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ১৫শ’ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। চলমান ১৫শ’ মামলার মধ্যে নারী ও শিশু মামলা ১২শ’, পিটিশন মামলা ২০০ এবং মানব পাচারের ১০০ মামলা রয়েছে।’ তিনি বলেন, আদালতে সাধারণত যৌতুকের জন্য মারধরের মামলাগুলো বেশি হয়। প্রমাণের অভাবে এ ধরনের ৯০ ভাগ মামলা খালাস হয়। এছাড়া সাক্ষীর অভাবে ৯০ ভাগ ধর্ষণ মামলা খালাস হয়।’

খালাসের একটি রায় পর্যালোচনায় দেখা যায়, যৌতুকের এক লাখ টাকার জন্য ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ রেহানা আক্তার রুমা তার স্বামী রুবেল মিয়ার বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহআলী থানায় মামলা করেন। ওই বছরের ২ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত মামলায় রুবেল জেলহাজতে ছিলেন। ২০১৫ সালের ১৯ মে ওই থানার এসআই সাইফুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় রুবেলের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেন। রাষ্ট্রপক্ষ মামলার বাদীকে সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করলে রেহানা আক্তার রুমা বলেন, ‘আসামি আমার স্বামী। তার সঙ্গে আপস-মীমাংসা হয়েছে। তিনি মামলার দায় থেকে খালাস পেলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’ ২০১৫ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রুবেল মিয়াকে খালাস প্রদান করেন।

জানতে চাইলে দুই নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এপিপি মো. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অনেক সময় মামলায় সাজা হওয়ার ভয়ে টাকার বিনিময়ে আদালতের বাইরে আসামি ও বাদী পক্ষের আপস-মীমাংসা হয়ে যায়।



এ জন্য আদালতে অধিকাংশ মামলা খালাস হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সত্য ঘটনায় প্রত্যক্ষ সাক্ষী আসামির ভয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেন না। মামলা হওয়ার পর বারবার সাক্ষীর সমন ফেরত আসে। সাক্ষীর অভাবে মামলা নিষ্পত্তি হয়। অনেক ক্ষেত্রে ঘর-সংসার করার সমোঝতার ভিত্তিতেও মামলা আপস হয়। আবার মিথ্যা মামলায় অনেকেই ভুক্তভোগী হয়। পুরুষ নির্যাতনের শিকার হলেও পুরুষ নির্যাতন দমন আইন নেই বলে সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিছুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন যথেষ্ট ঠিক আছে। তদন্ত ঠিক মতো করলেই প্রতিটি মামলার প্রকৃত ফলাফল পাওয়া যাবে।’

মিথ্যা মামলায় অনেক পুরুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুরুষ নির্যাতন দমন আইন করার প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না এখনও এটার প্রয়োজন আছে। তবে ভুক্তভোগী পুরুষরা আইনের সহায়তা চাইলে তাদের অবশ্যই তা দেয়া হবে।’

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, : ১২ এপ্রিল, ২০১৬

No comments:

Post a Comment